RBI কেন ইচ্ছেমতো টাকা ছাপে না? জানুন মুদ্রা ছাপার বাস্তবতা ও অর্থনীতির সত্যি!

 টাকা ছাপলেই কি সব সমস্যার সমাধান? জানুন RBI-এর সীমা ও বাস্তবতা

একজন তরুণ ভারতীয় ব্যক্তি চিন্তিত মুখে প্রশ্ন করছে – RBI কেন বেশি টাকা ছাপে না, একটি 2D কার্টুন ডিজিটাল ইলাস্ট্রেশনে অর্থনৈতিক সংকট ও মুদ্রাস্ফীতির প্রসঙ্গ তুলে ধরা হয়েছে।


১. অর্থনীতি সংকটে পড়লে RBI কেন টাকা ছাপে না?

অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিলে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন—“RBI টাকা ছাপে না কেন?” বা “সরকার ইচ্ছেমতো টাকা ছাপলে ক্ষতি কোথায়?” বাস্তবে বিষয়টি খুবই সংবেদনশীল ও নিয়ন্ত্রিত। বিপুল পরিমাণ টাকা ছাপা মানেই বাজারে অতিরিক্ত অর্থের সরবরাহ, যা মুদ্রাস্ফীতির হার হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি করে। যদি উৎপাদন না বাড়ে অথচ বাজারে টাকার পরিমাণ বেড়ে যায়, তাহলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যায়, এবং টাকার ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। ইতিহাসে জিম্বাবুয়ে ও ভেনেজুয়েলার হাইপারইনফ্লেশন এই প্রবণতার ভয়াবহতা প্রমাণ করেছে। ফলে RBI শুধু সরকারের চাহিদায় নয়, বরং GDP, রিজার্ভ, বাজার চাহিদামূল্যস্থিতি বিশ্লেষণ করেই টাকা ছাপে। তাই, RBI কেন টাকা ছাপে না—এই প্রশ্নের জবাবে রয়েছে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার দায় ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপত্তা।

২. সংকট কীভাবে একটি অর্থনীতির দৃঢ়তা পরীক্ষা করে

একটি সংকট যখন আসে, তখন সেটি শুধু জনস্বাস্থ্যের নয়, বরং একটি দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতারও চূড়ান্ত পরীক্ষা। যেমন ২০২০ সালের কোভিড-১৯ মহামারী ভারতের জন্য ছিল এক ভয়াবহ বাস্তবতা — যেখানে স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল, কোটি মানুষ চাকরি হারিয়েছিল, এবং সরকারের ব্যয়চাপ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়েছিল। অক্সিজেন, হাসপাতাল, ভ্যাকসিন ও রেশনিং—সব কিছুর জন্য প্রয়োজন ছিল বিপুল অর্থ। কিন্তু প্রশ্ন দাঁড়ায়, “সরকার কি এই বিশাল চাপ একাই সামাল দিতে পারে?” বাস্তবতা হলো, সরকার তার নিজস্ব আয় ও কর আদায়ের সীমার মধ্যে থেকেই খরচ চালাতে বাধ্য। সংকটে যখন আয় কমে যায়, তখন সরকারের একমাত্র ভরসা হয় তার শেষ ভরসার প্রতিষ্ঠান—RBI। কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে RBI সরকারকে সাপোর্ট দিতে পারে ঋণ, লিকুইডিটি ও নীতিগত সমন্বয়ের মাধ্যমে, তবে সেটাও নির্দিষ্ট নিয়ম ও শর্ত অনুযায়ী। তাই, যেকোনো বড় অর্থনৈতিক সংকটে একটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারের যৌথ সমন্বয়-ই হয়ে ওঠে আসল শক্তি।

৩. RBI কেন টাকা ছাপে?

 ✅ ফিস্কাল ঘাটতির বাস্তবতা ও সরকারের সীমাবদ্ধতা

সরকার দেশের অর্থনীতি চালাতে কর (income tax, GST, শুল্ক ইত্যাদি) আদায় করে, কিন্তু একটি বড় ও জনবহুল দেশে তা প্রায়ই যথেষ্ট হয় না। বিশেষ করে সংকটকালে আয় কমে গিয়ে সরকারের ব্যয় রাজস্ব ছাড়িয়ে যায়, যার ফলে সৃষ্টি হয় Rajkosh Ghati বা Fiscal Deficit। এই ঘাটতি মানে হলো সরকার যত টাকা আয় করছে, তার চেয়ে বেশি খরচ করতে হচ্ছে — যেমন স্বাস্থ্য, শিক্ষাব্যবস্থা, কৃষি ভর্তুকি বা পরিকাঠামো উন্নয়ন। ভারতের মতো দেশে সরকার চেষ্টা করে GDP-এর ৩.৫% এর মধ্যে ঘাটতি ধরে রাখতে, কিন্তু অনেক সময় তা ৬% বা তারও বেশি হয়ে যায়।

✅ RBI-এর ভূমিকা ও Monetizing the Deficit

যখন বাজার বা বিদেশি উৎস থেকে ঋণ পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে, তখন সরকার ভরসা করে RBI-এর ওপর — একে বলে ‘Monetizing the Deficit’। অর্থাৎ, RBI নতুন টাকা ছাপিয়ে সেই অর্থে সরকারকে ঋণ দেয় যাতে সে নিজের ব্যয় চালাতে পারে। তবে এই প্রক্রিয়া সরাসরি টাকার যোগান বাড়িয়ে দেয়, ফলে এর প্রভাব পড়ে মুদ্রাস্ফীতিতে। তাই RBI এই সিদ্ধান্ত নেয় শুধুমাত্র সংকটকালে ও অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে। এটি একরকম অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করার কৌশল, যেখানে উন্নয়ন এবং মূল্যস্থিতি—দুইয়ের মধ্যে সমন্বয় রাখা হয়।

৪. টাকা ছাপার বিপদ

✅  অতিরিক্ত টাকা ছাপা ও চালের সহজ উদাহরণ

ধরুন একটি দেশে মাত্র দুইজন মানুষ বাস করে। প্রত্যেকে আয় করে ₹১০ এবং বাজারে আছে মোট ২ কেজি চাল। তখন চালের দাম যদি হয় ₹১০ প্রতি কেজি, তাহলে প্রত্যেকে ১ কেজি করে চাল কিনতে পারবে। এখন যদি সরকার হঠাৎ তাদের প্রত্যেককে ₹২০ করে দেয়, অথচ চালের সরবরাহ একই থাকে (২ কেজি), তাহলে দুইজনই পুরো চাল কিনে নিতে চাইবে। এই চাহিদা দেখে দোকানদার দাম বাড়িয়ে প্রতি কেজি চাল ₹২০ করে দেবে। অর্থাৎ, আগে ₹১০ দিয়ে ১ কেজি চাল মিলত, এখন সেই একই চালের জন্য লাগছে ₹২০। এটিই হল মুদ্রাস্ফীতি, যার সরাসরি কারণ অতিরিক্ত টাকা ছাপা।

✅  মূল্যবৃদ্ধির ঝুঁকি ও অর্থনীতির ভারসাম্য

যখন সরকার বা RBI অনিয়ন্ত্রিতভাবে টাকা ছাপে, তখন বাজারে অর্থের পরিমাণ বেড়ে যায় কিন্তু পণ্য ও পরিষেবার পরিমাণ সেই হারে বাড়ে না। এর ফলে অতিরিক্ত চাহিদা সৃষ্টি হয়, যা মূল্যবৃদ্ধির ঝুঁকি (Inflation Risk) অনেক গুণ বাড়িয়ে দেয়। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যায়, সঞ্চয়ের মান কমে যায়, এবং দীর্ঘমেয়াদে টাকার ওপর মানুষের আস্থা নষ্ট হয়। তাই অর্থনীতিতে টাকার যোগান ও উৎপাদনের ভারসাম্য বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ — না হলে অর্থনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হওয়া খুবই স্বাভাবিক।

৫. নতুন টাকা ছাপার আগে যেসব বিষয় বিবেচনা করা হয়

৫.১ মুদ্রাস্ফীতি (Inflation)

✅ মুদ্রাস্ফীতির সংজ্ঞা

মুদ্রাস্ফীতি হচ্ছে এমন একটি অর্থনৈতিক অবস্থা যেখানে সময়ের সাথে সাথে পণ্য ও পরিষেবার দাম বেড়ে যায়, ফলে একই টাকায় আগের মতো জিনিস কেনা সম্ভব হয় না। উদাহরণস্বরূপ, যদি এক কেজি চিনি আজ ₹৪০-এ পাওয়া যায় কিন্তু ছয় মাস পর তার দাম হয় ₹৫০, তাহলে সেটি মুদ্রাস্ফীতির ইঙ্গিত দেয়। এটি মূলত অর্থনীতিতে চাহিদা ও জোগানের ভারসাম্য বিঘ্নিত হলে ঘটে, বিশেষ করে যখন বাজারে টাকার সরবরাহ বেড়ে যায় অথচ উৎপাদন না বাড়ে।

✅ Hyperinflation এর উদাহরণ: জিম্বাবুয়ে, ২০০৮

Hyperinflation হলো মুদ্রাস্ফীতির একটি ভয়াবহ চেহারা, যেখানে মূল্যবৃদ্ধির হার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। জিম্বাবুয়ে ২০০৮ সালে এর ভয়াবহ অভিজ্ঞতা লাভ করে — যেখানে বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতি ছিল ২৩০ মিলিয়ন শতাংশ! এতটাই ভয়ংকর ছিল পরিস্থিতি যে, এক কাপ কফি কিনতে লক্ষ লক্ষ নোট দরকার হতো। কারণ ছিল সরকার ইচ্ছেমতো অতিরিক্ত টাকা ছাপিয়ে ফেলেছিল কিন্তু অর্থনীতিতে উৎপাদন বাড়েনি। এই উদাহরণ আমাদের শেখায়, অনিয়ন্ত্রিতভাবে টাকা ছাপা একটি দেশের মুদ্রাকে মূল্যহীন করে তুলতে পারে।

✅ মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়া

যখন বাজারে অতিরিক্ত টাকা ছাপা হয়, তখন তার সরাসরি প্রভাব পড়ে মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতার ওপর। আগে যে ₹১০০ দিয়ে ৫ কেজি চাল কেনা যেত, মুদ্রাস্ফীতির ফলে সেই একই পরিমাণ চাল কিনতে এখন ₹১৫০ বা ₹২০০ লাগতে পারে। এর মানে টাকা থাকলেও তার মূল্য কমে যায় — অর্থাৎ, আপনি আগের মতো পণ্য কিনতে পারছেন না। RBI নতুন টাকা ছাপার আগে এই ক্রয়ক্ষমতা বিশ্লেষণ করে, যাতে সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রা হঠাৎ ব্যাহত না হয়।

৫.২ মোট দেশজ উৎপাদন (GDP)

✅ GDP কী ও কেন গুরুত্বপূর্ণ

মোট দেশজ উৎপাদন (GDP) হল একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দেশের ভেতরে উৎপাদিত সব পণ্য ও পরিষেবার মোট মূল্য। এটি একটি দেশের অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য বোঝার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সূচক। GDP যত বেশি, অর্থনীতি তত শক্তিশালী বলে ধরা হয়। সরকারের রাজস্ব, জনগণের আয়, বিনিয়োগের পরিমাণ — সব কিছুই GDP বৃদ্ধির সঙ্গে জড়িত। তাই RBI যখন নতুন টাকা ছাপার কথা ভাবে, তখন GDP-এর গতি ও স্থিতি একটি প্রধান বিবেচ্য বিষয়

✅ GDP বাড়লে টাকা ছাপার যুক্তিসঙ্গততা

যখন একটি দেশের GDP বাড়ে, তার মানে দেশের উৎপাদন ও আয়ের পরিমাণ বেড়েছে। এই বাড়তি উৎপাদন ও প্রবৃদ্ধিকে সাপোর্ট করতে কিছুটা অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন হয়, যা অর্থনীতিতে কার্যকর লেনদেন চালু রাখতে সাহায্য করে। সেক্ষেত্রে RBI সীমিত হারে নতুন টাকা ছাপতে পারে, যা বাজারে চাহিদা পূরণ করে কিন্তু দাম বৃদ্ধির ঝুঁকি তৈরি করে না। তাই GDP বাড়লে টাকা ছাপা একপ্রকার যুক্তিসঙ্গত ও নিয়ন্ত্রিত সিদ্ধান্ত হতে পারে।

✅ টাকা ছাপা যেন উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়

RBI বা সরকার যদি GDP না বাড়ার পরেও টাকা ছাপে, তাহলে বাজারে চাহিদা বেড়ে যায়, কিন্তু পণ্য বা পরিষেবার সরবরাহ বাড়ে না। ফলে মুদ্রাস্ফীতি বাড়ে এবং টাকার মান কমে যায়। তাই নতুন টাকা ছাপার আগে নিশ্চিত করতে হয় যে, উৎপাদন বৃদ্ধি হচ্ছে কিনা, এবং সেই উৎপাদনের সাথে টাকার জোগান সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা। এই ভারসাম্য বজায় রাখাই হল একটি সুস্থ অর্থনীতির চাবিকাঠি।

৫.৩ ন্যূনতম রিজার্ভ ব্যবস্থা (Minimum Reserve System)

✅ স্বর্ণ রিজার্ভ, বৈদেশিক মুদ্রা ও BOP-এর ভিত্তি

ভারতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক RBI নতুন টাকা ছাপার ক্ষেত্রে ন্যূনতম রিজার্ভ ব্যবস্থা (MRS) অনুসরণ করে। এই ব্যবস্থায় টাকা ছাপার পেছনে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ স্বর্ণ রিজার্ভ, বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ এবং Balance of Payment (BOP) এর পাওনাদি থাকতে হয়। এর মানে, বাজারে ছাড়া প্রতিটি টাকার পেছনে একটি বাস্তব ও মূল্যবান সম্পদের ভিত্তি থাকে, যা জনগণের আস্থা বজায় রাখতে সাহায্য করে।

✅ ১৯৫৬ সাল থেকে কার্যকর MRS

ভারতে ন্যূনতম রিজার্ভ ব্যবস্থা প্রথম চালু হয় ১৯৫৬ সালে, পূর্ববর্তী সম্পূর্ণ রিজার্ভ ব্যবস্থার পরিবর্তে। তখন থেকেই RBI নতুন নোট ছাপার জন্য আর সম্পূর্ণ রিজার্ভ রাখার বাধ্যবাধকতায় ছিল না, বরং ন্যূনতম পরিমাণ রিজার্ভ থাকলেই চলত। এর ফলে ভারতের অর্থনৈতিক লেনদেন সহজ হয় এবং টাকার জোগান অর্থনৈতিক চাহিদা অনুযায়ী বাড়ানো সম্ভব হয়। তবে এই ব্যবস্থায়ও নির্দিষ্ট নিয়মনীতির মধ্যে থেকে কাজ করতে হয়।

✅ মোট ₹২০০ কোটি রিজার্ভ বাধ্যতামূলক, যার মধ্যে ₹১১৫ কোটি স্বর্ণে

বর্তমানে RBI-র জন্য ন্যূনতম রিজার্ভের পরিমাণ নির্ধারিত আছে ₹২০০ কোটি টাকা, যার মধ্যে কমপক্ষে ₹১১৫ কোটি থাকতে হবে স্বর্ণের রূপে (bullion বা সোনার মুদ্রা)। বাকি অংশ থাকে বৈদেশিক মুদ্রা ও অন্যান্য রিজার্ভে। এই রিজার্ভ সাধারণত RBI-এর ইস্যু বিভাগে (Issue Department) সংরক্ষিত থাকে এবং এটি প্রমাণ করে যে বাজারে যে পরিমাণ মুদ্রা চলাচল করছে, তার একটি নির্দিষ্ট অংশ নিরাপদ সম্পদ দ্বারা ব্যাকড বা সমর্থিত

৬. জীর্ণ ও ছেঁড়া নোট (Soiled & Mutilated Notes)

✅ জীর্ণ নোট: ব্যবহারে নোংরা হয়ে যাওয়া

জীর্ণ নোট হলো এমন কাগুজে টাকা যেটি দীর্ঘদিন ব্যবহারে নোংরা, কালিমাযুক্ত বা মলিন হয়ে পড়েছে। অনেক সময় নোট দুটি টুকরো হয়ে গেলেও যদি সেগুলো একত্রে সঠিকভাবে জোড়া দেওয়া থাকে, তাহলে তা এখনও জীর্ণ নোটের শ্রেণিতে পড়ে। এই ধরনের নোটগুলি আর বাজারে চালানোর মতো অবস্থায় থাকে না, তাই ব্যাংক বা RBI-তে জমা দিয়ে নতুন নোট নেওয়া সম্ভব।

✅ ছেঁড়া নোট: অংশবিশেষ অনুপস্থিত বা একাধিক টুকরো

ছেঁড়া বা বিচ্ছিন্ন নোট (Mutilated Notes) এমন নোট যা আকারে অসম্পূর্ণ, কোন অংশ কাটা বা একাধিক টুকরোতে বিভক্ত। যেমন: কোনও ₹৫০০ নোটের এক কোণা নেই বা মাঝখান কেটে গেছে। এই ধরণের নোট আর আইনি বৈধতা রাখে না এবং সেগুলিকে বৈধ লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা যায় না। RBI নির্দিষ্ট নিয়ম অনুযায়ী এর মূল্য ফেরত দেয় অথবা প্রতিস্থাপন করে।

✅ এসব নোট ধ্বংস ও পরিবর্তে নতুন নোট ছাপা

যেসব নোট আর ব্যবহারযোগ্য নয়—সেগুলো RBI-এর আঞ্চলিক দপ্তরে হিসাব করে সংগ্রহ করা হয়, এবং পরবর্তীতে নিরাপত্তা পরিবেষ্টিত ইনসিনারেটরে (দাহন চুল্লি) পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়। প্রতিটি ধ্বংসকৃত নোট হিসাবের অন্তর্ভুক্ত থাকে যাতে অতিরিক্ত বা অনিয়ন্ত্রিত টাকা ছাপার প্রয়োজন না পড়ে। RBI এই নোটগুলোর জায়গায় নতুন নোট ছাপে, যাতে অর্থনীতির লেনদেন চলমান থাকে।

✅ RBI-এর হিসাব ও নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া

RBI-এর ইস্যু বিভাগ ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ পুরনো নোটের হিসাব রাখে এবং প্রতিবছর কত সংখ্যক নোট বাতিল হচ্ছে এবং নতুন ছাপতে হবে, তার একটি পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট তৈরি করে। এই প্রক্রিয়াটি GDP, মুদ্রাস্ফীতি এবং সার্কুলেশনের চাহিদা অনুযায়ী মূল্যায়ন করা হয়। এই তথ্য বিশ্লেষণ করে RBI কেন্দ্রীয় সরকারকে মুদ্রণ অনুমোদনের জন্য প্রস্তাব পাঠায়, এবং তা অনুমোদিত হলে নতুন নোট ছাপার কাজ শুরু হয়।

✅ ৭. RBI ও ভারত সরকারের সমন্বয়

ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংক (RBI) ও ভারত সরকার একসঙ্গে কাজ করে নতুন নোটের ডিজাইন, নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য ও মূল্যমান নির্ধারণে। এই প্রক্রিয়ায় RBI নোটের রঙ, আকার, জলছাপ, সিকিউরিটি থ্রেড ইত্যাদি নিয়ে সরকারকে প্রস্তাব দেয় এবং চূড়ান্ত অনুমোদনের পর নোট ছাপা শুরু হয়। তবে ₹১ মূল্যের কাগুজে মুদ্রা ও সব ধরনের ধাতব মুদ্রা তৈরির একমাত্র দায়িত্ব থাকে ভারতের সরকারের হাতে, যা India Government Mint-এ প্রস্তুত হয়। এছাড়াও, RBI প্রতিবছর সরকারকে লভ্যাংশ প্রদান করে, যা রাজস্ব ও অর্থনৈতিক নীতির পরিকল্পনায় সরাসরি প্রভাব ফেলে। এই সমন্বয়ই নিশ্চিত করে যে দেশের মুদ্রা ব্যবস্থাপনা সঠিক, সুরক্ষিত ও জনমুখী থাকে।

৮. নতুন মুদ্রার চাহিদা নির্ধারণের পদ্ধতি

✅  চাহিদা নির্ধারণের সূত্র ও যাচাই

RBI নতুন মুদ্রা ছাপার আগে একটি নির্দিষ্ট হিসাব সূত্র ব্যবহার করে দেশের আর্থিক চাহিদা নির্ধারণ করে। সেই সূত্র হল:
মোট ছাপার পরিমাণ = D (প্রকল্পিত GDP) – N (বর্তমান মজুত) + R (জীর্ণ নোটের প্রতিস্থাপন চাহিদা)
এছাড়া, যেকোনো জরুরি পরিস্থিতি বা অনিশ্চয়তা মোকাবেলায় অতিরিক্ত ৫% মুদ্রা ছাপার অনুমোদন দেওয়া হয়। এই হিসাবকে বাস্তবসম্মত করতে RBI তার আঞ্চলিক অফিস ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য যাচাই করে, যাতে অঞ্চলভিত্তিক মুদ্রা চাহিদা নির্ভুলভাবে বিবেচনায় আনা যায়।

✅ কেন্দ্রীয় সমন্বয় ও ছাপার প্রক্রিয়া

এই তথ্য ও অনুমানের সমন্বয় করে RBI-এর DCM বিভাগ (Department of Currency Management), মুম্বই চূড়ান্ত পরিকল্পনা তৈরি করে। সেখানে ডিনোমিনেশনভিত্তিক (₹১০, ₹৫০, ₹১০০, ₹২০০ ইত্যাদি) মুদ্রার প্রয়োজন নির্ধারণ করা হয় এবং তদনুযায়ী মুদ্রণ আদেশ পাঠানো হয় দেশের চারটি প্রিন্টিং প্রেসে। নতুন নোট ছাপা হয় বছরের চারটি কোয়ার্টারে ভাগ করে, যাতে দেশজুড়ে চাহিদা অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে রেমিট্যান্স পাঠানো যায়। পুরো প্রক্রিয়াটির তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ করে RBI-এর ইস্যু বিভাগ (Issue Department), যা নিশ্চিত করে যে মুদ্রা সরবরাহে কোনো ঘাটতি না ঘটে এবং দেশের আর্থিক লেনদেন স্বাভাবিকভাবে চলতে থাকে

🔚 টাকা ছাপা মানেই সমাধান নয়

দেশের অর্থনীতি যখন সংকটে পড়ে, তখন সাধারণ মানুষ সহজ সমাধান খোঁজে — যেমন, “সরকার বেশি টাকা ছাপলেই তো সব সমস্যার সমাধান!” কিন্তু বাস্তবতা অনেক জটিল। টাকার অযাচিত ছাপা মুদ্রাস্ফীতি, পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করতে পারে, যার বোঝা শেষমেশ পড়ে সাধারণ মানুষের কাঁধেই। তাই RBI ও ভারত সরকার মিলে অত্যন্ত গবেষণা, হিসাব, ও নিরাপত্তার বিবেচনায় নতুন টাকা ছাপে — GDP, রিজার্ভ, জীর্ণ নোট, ও ভবিষ্যৎ ঝুঁকি বিশ্লেষণ করে।

আমাদের বোঝা উচিত, টাকা ছাপার বিষয়টি কেবল প্রিন্টারের বাটন টেপা নয়, বরং এটি একটি দেশীয় অর্থনীতির ভারসাম্য রক্ষার কৌশল। তাই, কেউ যদি বলে "সরকার আরও টাকা ছাপছে না কেন?" — তখন আপনি যুক্তিসহকারে এই ব্যাখ্যা তুলে ধরতে পারবেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Please do not enter any spam link in the comment box.

নবীনতর পূর্বতন